Sunday, July 23, 2017

লুঙুদু পালাহ- এক, দুই, তিন ও চার

[ফেসবুকে লংগদু পালাহ-১, ২, ৩, ৪ আকারে এই লেখাগুলো লিখেছিলাম। আরো কিছু বিষয়ে লেখার কথা থাকলেও আরো নতুন সমস্যা এসে যোগ হবার কারণে এবং কিছু ক্ষেত্রে তথ্যের মিসিং লিংকেজ থাকার কারণে আর এ বিষয়ে লিখিনি। তবে এই চারটি লেখা একত্র করে ব্লগে প্রকাশ করলাম। ধন্যবাদ]

লংগদু পালাহ-১
তারিখঃ ২৬ জুন, ২০১৭
চাদিগাঙ ছাড়া পালাহ হলো চাকমাদের চট্টগ্রাম থেকে পালিয়ে যাওয়ার কাহিনী। চাকমাদের একটি বিশ্বাস হলো, চাদিগাঙ ছাড়া পালাহ বা চাদিগাঙ পালিয়ে যাওয়ার গীতিকাহিনী যেখানে সেখানে গাওয়া যায় না। যদি এই গীতিকাহিনী কোনো গ্রামে গাওয়া হয়, তবে সেই গ্রাম থেকে সবাইকে পালিয়ে চলে যেতে হয় বা সেই গ্রাম চাকমাদের হারাতে হয়। চাদিগাঙ ছাড়া পালাহ’র মতো চাকমাদের এখনো নিজেদের গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হতে হয়। বিগত ৪০/৪৫ বছরের মধ্যে চাদিগাঙ ছাড়া পালাহ’র মতো চাকমাদের কতো গ্রাম যে ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে তার সঠিক হিসাব আসলে কোথাও নেই। কিন্তু যেই গ্রাম বা এলাকা তাদের ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে, সেই গ্রাম বা এলাকায় কেউ চাদিগাঙ ছাড়া পালাহ না শুনেও তাদেরকে নিজেদের ভিটেমাটি ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে। অর্থাৎ, চাদিগাঙ ছাড়া পালাহ বা গীতকাহিনী শুনলেও যে চাকমাদের নিজেদের গ্রাম ছেড়ে যেতে হবে তা হয়তো সঠিক নাও হতে পারে।
চাকমাদের মতো পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যান্য জাতিসত্তারও নিশ্চয়ই এই ধরণের গীতিকাহিনী থাকতে পারে। অথবা নাও থাকতে পারে। তবে কেউ যদি লংগদু এলাকার জনগণের দুঃখের কাহিনী গীতিকাহিনী হিসেবে চাদিগাঙ ছাড়া পালাহ’র মতো করে রচনা করতো, তবে তা শুনতে কেমন হতো জানা নেই। চাদিগাঙ ছাড়া পালাহ এমন করুণভাবে গাওয়া হতো যে, যারা এই কাহিনী শুনতো তাদেরকে কাঁদতে হতো। কেউ কি লংগুদুবাসীর দুঃখের কথা করুণ সুরে লংগুদু পালাহ হিসেবে রচনা করতে এগিয়ে আসবেন?
সে যাই হোক, আমি এখানে লংগুদুবাসীদের দুঃখের কাহিনী বর্ণনা করার সাহ দেখাবো না। তবে সেখানে গতকাল গিয়ে যা দেখে এসেছি এবং শুনে এসেছি তার কিছুটা বর্ণনা করার চেষ্টা এখানে করবো।
জীবনের শেষভাগে এসে অশ্বিনীকুমার কার্বারীর উপলব্ধি
অশ্বিনী কুমার চাকমা। তিনি তিনটিলা গ্রামের কার্বারী। বয়স প্রায় ষাট বা সত্তরের কাছাকাছি। বেঁটেখাটো মানুষ। সবসময় হাসিখুশিই থাকেন। তার ঘরও এবার পুড়ে গেছে। ১৯৮৯ সালের ৪ মে প্রথমবার তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে গিয়েছিল। সাথে তাদের গ্রামও পুড়ে গিয়েছিল। আমরা একসাথে তিনটিলার পোড়া ঘরগুলো দেখতে গিয়েছিলাম। হাঁটতে হাঁটতে তিনি বললেন, সবকিছু ধ্বংস হবার পরে, সবকিছু পুড়ে যাবার পরে এখন তিনি আর নতুনভাবে সবকিছু গড়ে তোলার আশা করেন না। একজীবনে আর কতোই বা সম্ভব? কত কষ্ট করে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, দীর্ঘ বছর তিলতিল পরিশ্রম করে একএকটি পরিবার নিজেদের সম্পদ-সম্পত্তি বাড়িয়ে তুলেছিল এবং ঘরবাড়ি তুলেছিলো। একটু শান্তির আশায় তারা এই ঘরবাড়ি তুলেছিল। জীবনের বাকি সময়টা সুখে শান্তিতে তারা কাটাতে চেয়েছিল। কিন্তু ১৯৮৯ সালের পরে আবার তাদের শেষ বয়সে এই দশায় পড়তে হলো। তিনি কোনো প্রকার বিরক্তি ও দুঃখ না দেখিয়ে হেসে হেসেই বললেন, ’এই জিঙানিত আর নুও কিজু গুরিবার আঝা ন গরঙআর। গুরিলে পো শা’উনে গুরিবার চেরেস্তা গুরি পারঅন। আমি দ আর পারিদঙ নয়। বয়চ দ ওই জিএগোই, কদক আর পারে আর?’
জুম্ম জনগণের এই এক আপদ! দুঃখের কথাও তারা এমন হেসেখেলেতাদের জীবনের দুঃখ বেদনার কথা বলে যে, মনেহয় এই দুঃখ-কষ্ট কিছুই নয়! আসলে প্রতিনিয়ত দুঃখের মাঝে থাকতে থাকতে দুঃখ ও সুখ এই দুয়ের মধ্যে পার্থক্য করতেও যেন আমরা ভুলে গেছি!
অশ্বিনী কুমার চাকমা যে কথা অক্লেশে বললেন, তা যে কত ক্লেশকর, কত বেদনাময় ও খেদযুক্ত তা সাদাকথায় বোঝানো চাট্টিখানি কথা নয়। একজন মানুষ তার জীবনের প্রারম্ভিক পর্বে একবার নিজের বাড়িঘর ধ্বংস হতে দেখার পরে, নিজের আত্মীয়স্বজনকে মারা যেতে দেখার পরে, নিজের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হবার পরে, পালিয়ে পালিয়ে জীবন কাটানোর পরে আবার নতুন করে যখন সে স্বপ্ন দেখা শুরু করলো। এবং তারপরে জীবনের শেষভাগে এসে সে যদি দেখে যে, সে সারাজীবনে যা সঞ্চয় করেছিল, যা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য তিলেতিলে গড়ে তুলেছিল, তা কারো প্রতিহিংসার আগুনে লেলিহান শিখা হয়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়ে গেছে, সে সর্বস্বান্ত হয়ে গেছে। তখন তার জীবন নিয়ে আর তখন কীইবা ভাবার আছে বা কীইবা ভাবার থাকতে পারে?
তাই অশ্বিনী কুমারেরও আর কিছুই ভাবার নেই! বাকি যা ভাবার আছে তা হলো, মরণ যেন ভালভাবেই হয়!


লুঙুদুত ধজা-পড়া-লড়া-পুড়া হেই পানা পালাহ-২
তারিখঃ ২৬ জুন, ২০১৭
লুঙুদুত জিওংগে আদিক্ক্যেগুরি। এককধায় যেবার কধা ন থ্যালেইও জানা। জেবার আগে তারাত্তেই কী নেজেই দিম চিদে গুজ্জোং। একজন'অর আর কদক তেঙা থাই! শেজেনদি ১০ কেজি আম কিনিলুং। সিউন যারে পারঅং হাবেবার চিদে থেব'অ গুরি নেজেইলুং। লুঙুদুত ম সমারে একজন গুরো ভেই আর মটরসাইকেল চালিয়েবো এল'অ। 
আমি লুঙুসুত জেইনেই পুড়া জিইয়ে আদাম'অত সুমিলং। এগগান আ' পুড়িই জিইয়ে ঘরত পানি হেবাত্তেই উদিলং। সি'ওত কধা অহল'অ ঘর আদ্যান্যা পুড়িই জিইয়ে মানজো সমারে। পরিচয় অহল' একজনদোই, য্যা ভেইয়ে ভেইয়ে মরামরিত তা নেককোরে আহরেইয়ে। তুমি সুবীর ওস্তাদ'অ নাং শুনি থেবা।
আমি আমা হিল চাদিগাং-অর বিজগ'অর এমন এগগান সময় পা'আর গুরির, জিওত ভেইয়ে ভেইয়ে মরামরি দেঘির। আহরেইয়েই আমা পরিচিত অপরিচিত ইত্তোকুদুম। আহরেইয়েই আমা জাদ'অর বাজা বাজা গম মানুচ্চুনোরে। ইওত তারা নাং আর ন তুলিম আর। তবে পোল্লেম পোল্লেম জ্যাক্কেনে জেএসএস এম এন লারমা পন্থীলোই ইউপিডিএফ'অর আইপা'আপি অহর স্যাক্কেনে মুই দীঘিনালা ভৈরফা সিন্দি তারার একজনদোই বেড়েইওং। সে মানুচচোরে লইনেই কধা রু'উত্তেদে, ত্যা আমা মানুচ জেদাবাদে আগুনওত পুড়িই মারেই ফেলেইয়ে। পোল্লেম পোল্লেম আই'পা'আপি লক্কেনে মুই তাল্লোই এক সমারে দিন্নোবো আর রেত্তোবো কাদেইওং। আমি একসমারে চাগালা থিগে বেড়েইয়েই, আমা আদাম্যাউনোরে জাগাজুমি বাজেবাত্তেই সাহজ দেই। তবে পরে ভালকদিন পরে শুনংগে তারে আর'অ কনজনে মারেই ফেলেইওন। তা মোক পো ঝি উনোর কধা মুই এব'অ মনত তুলোং। তারা কেনজান আঘন মুই হবর ন পাং। তবে সে সহযোদ্ধা বড়ভেইবো মুরিবার পরে মুই মনত দুক পিওং। তার নানা ভুলচুক থ্যালেও তার মরানাই মুই নিজ'অ সহযোদ্ধা ধুক্কেন মনত কস্ত পিওং।
লুঙুদুত থাগত্তে সিদু হানক্কন মুই সুবীর ওস্তাদ'অ মোককোলোই কধা কুইওং। তারার সুক-দুঘ'ও কধা বুজিবার চেস্তা গুজ্জোং।
ইঙিরি আদামে আদামে জাগায় জাগায় আমা জুম্ম মানেইওর কত'অ মিলে মা-বোন তার/তারার পো-ভেই-নেক-বাপ আহরেইওন! সুবীর ওস্তাদ'অ মোক্কো কধা চিদে গুরিই মত্তুন মনত উত্তে তারা বেগ'অর কধা।
মত্তুন মনত উত্তে ম বাপপো কধা। মনত উত্তে আর'অ বাপ-জিদু-আজু-দা-হাক্কা ইত্তোকুদুমবলা বা ইত্তোকুদুম ন উইয়ে আর'অ শত শত আমা শহীদ মানেইওর কধা।

লুঙুদু পালাহ-৩
তারিখঃ ২৭ জুন, ২০১৭
১৯৮৯ সালের ৪ মে। লুঙুদুতে যে হামলা হয়েছিল তাতে নিহত হয়েছিল ৩২ জন বা তারও অধিক। ঘরবাড়ি পুড়ে গিয়ে সর্বস্বান্ত হয়েছিল ১ হাজারেরও অধিক। হামলা-হত্যার শিকার হয়ে পাহাড়ি জনগণ জায়গাজমি হারিয়েছিল শত হাজার একর।
লুঙুদুতে ১৯৮৯ সালে সংঘটিত হামলা নিয়ে ব্রিগ্রেডিয়ার সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম লিখেছেন,'.. বাঙালীরা উত্তেজিত হয়ে কতিপয় ভিডিপি সদস্যদের সহযোগীতায় ঘটনার দিন এবং তার পরদিন আগ্নেয়াস্ত্র, দা, বল্লম, কুঠার ইত্যাদি মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে করল্যাছড়ি, উল্টাছড়ি, শীলছড়ি, বগাপাড়া, আদ্রকছড়া এবং হরকুমার কার্বারী পাড়ায় উপজাতিদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়, লুটপাট চালায় এবং লোকজনকে আক্রমণ করে।(পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিপ্রক্রিয়া ও পরিবেশ পরিস্থিতির মূল্যায়ণ; ফেব্রুয়ারি, ২০০১; পৃষ্ঠা-১৩৪)। এই উদ্ধৃতিতে যে সকল গ্রাম বা এলাকার নাম দেয়া হয়েছে তার অনেক এলাকায় এখন পাহাড়ি জনগণ বসতি বজায় রাখতে পেরেছে কীনা তা আমার জানা নেই। তবে সাধারণভাবে পার্বত্য প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে চোখ বন্ধ করেই বলে দেয়া যায় যে, এই এলাকার শত হাজার একর জায়গা থেকে পাহাড়িরা সেটলারদের কাছ থেকে উচ্ছেদের শিকার হয়েছে এটাই বাস্তবতা। (যারা এ বিষয়ে জানেন তারা প্রকৃত তথ্য যোগ করতে পারেন)
সে সময় জুম্ম জনগণের উপর যে অত্যাচার অন্যায় অবিচার করা হয়েছিল তার প্রতিবাদ করারও সুযোগ তখন পার্বত্যবাসীকে দেয়া হয়নি। রাজা দেবাশীষ রায় তাঁর এক ফেসবুক নোটে এমনেস্টির উদ্ধৃতি দিয়ে এই তথ্য দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, রাঙামাটির জনগণকে বা প্রতিবাদ করার জন্য ঢাকায় পর্যন্ত যেতে বাধা দেয়া হয়েছিল।
সুতরাং, তখন এই অন্যায়ের প্রতিবিধান করার জন্য থানায় গিয়ে মামলা করার চিন্তাও কেউ করার সাহস করেনি। অথবা, মামলা যে করা যায় তা কারো মাথায়ও ছিলো না! অথবা দেশে বিদেশে এ নিয়ে প্রতিবাদ মিছিল সভা সমাবেশ করারও তেমন অনেক কেউ ছিলো না। তাছাড়া তখন দেশে ছিলো সামরিক শাসনের সময়। যে সকল পত্রিকা প্রকাশিত হতো তা ছিল সামরিক সরকারেরই নিয়ন্ত্রণে। এমন পাহাড়ি কোনো সাংবাদিক ছিলেন না বা সাহসী কোনো সাংবাদিক তখন সাহস নিয়ে ঘটনাস্থল ঘুরে দেখে পোড়া ঘরের ছবি তুলতেও আসেননি। বরং ঘটনাকে ভিন্নভাবেই হয়তো তখন দেশবাসীর কাছে তথ্যমাধ্যমের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়েছিল। এবং এতে জায়েজ বা বৈধ হয়ে গিয়েছিল একটি গণহত্যা সংঘটনের। পাহাড়িদের তাদের বাপদাদার ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদকেও এভাবেই হয়তো/নিশ্চিতভাবেই বৈধতা দিয়ে দেয়া হয়েছিলো।
কিন্তু এই আজকের ২০১৭ সালে এসে তার মাত্রা ও প্রকৃতির কিছুটা হেরফের হলেও নীতিগত দিক থেকে অধিপতি শ্রেনীর অবস্থান 'যা লাউ, তা কদু'ই রয়ে গেছে কীনা এই প্রশ্নটি জুম্ম ও সচেতন মহলের কাছ থেকে বারবার প্রকটিতই হচ্ছে।( ড্রাকোনিয়ান ৫৭ ধারা এখন আর সাদাসিধে সোজাসাপ্টা দুর্মুখ কথা বলতে উতসাহিত করে না বটে!)
তথ্য হলো ঘটনাত পরে প্রশাসন বাদী হয়ে সেটলার বাঙালিদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছে। মামলার ধরণ কী আমরা জানি না। মামলায় ব্যাপক মানুষের নাম উল্লেখ করে প্রকৃত পরিকল্পনাকারী ও হামলা বাস্তবায়নকারীদের আড়াল করা হচ্ছে কীনা তাও স্পষ্ট নয়। এছাড়া পাহাড়িদের দেয়া মামলায় এখনো বৃদ্ধা গুনমালা চাকমা হত্যার বিষয়টি যোগ করা হয়নি। অর্থাৎ যোগ করা হয়নি ৩০৭ ধারা। অন্যদিকে গত ২৫ জুন লুঙুদুতে গিয়ে জানা গেলো, ঘটনার মূলে যারা রয়েছে বলে সন্দেহের তালিকায় রয়েছে, তাদের মধ্য থেকে ৩৪ জন এরইমধ্যে উচ্চ আদালত থেকে অন্তর্বর্তীকালীন জামিন নিয়ে প্রকাশ্যেই ঘোরাফেরা করছে। এর মানে হলো যারা হামলায় জড়িত তারা এখন মুক্তভাবেই ঘুরছে, তারা ক্ষতির শিকার পাহাড়িদের সামনেই ঘোরাফেরা করছে।
উপরন্তু যোগ হয়েছে পাহাড়িদের ৪০ জনের বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা। মামলাটির সত্যতা শুন্যের চেয়েও নিম্নাংকে হলেও তার প্রায়োগিক দৃশ্যমান 'হুমকি ও ধামকি'দেয়ার যে 'বারতা বা বার্তা' রয়েছে, তা আমাদের সবাইকে শুধু ভাবাবে না বলে দুর্ভাবনা ও দুশ্চিন্তারও যে কারণ হবে তা-ই সত্য।
তদুপরি পার্বত্য সমস্যা 'আইনশৃংখলা জনিত' কোনো সমস্যা নয়। মামলা ও পালটা মামলা দিয়ে এই সমস্যার তিল পরিমাণ সুরাহার আশা করা দুরূহ বটে।
রাজনৈতিক দিকটি ও জুম্ম জনগণের অধিকারের দিকটি প্রাধান্যে না আসলে পার্বত্য সমস্যাটির অবস্থা 'সব সমস্যা Problem করে' দেয়ার মতো অবস্থা হবে এই আরকি!?!?

লুঙুদু পালাহ-৪
তারিখঃ ২৮ জুন, ২০১৭
লুঙুদু বাজার। সপ্তাহের শনিবার সেখানে সাপ্তাহিক বাজার বসে। ছিটেফোটা কয়েকটি বাদে বাকি সব দোকান বাঙালিদের মালিকানাধীন।
পাহাড়ে সচরাচর যা হয়, দোকানদার ও ব্যবসায়ীদের প্রায় সবাই অপাহাড়ি সেটলার অথবা সাধারণ বাঙালি। পাহাড়িদের জন্য ব্যবসা নিষিদ্ধ তা নয়! তবে ব্যবসা বা দোকানদারী করে টিকে থাকাটা হলো 'কল্পনাবিলাসীতা'রই মতো। কেউ আড়ম্বর করে দোকান দিলো বা ব্যবসার পত্তন ঘটালো। যে কোনো কৌশল বা উপায়ে হোক সেই দোকান বা ব্যবসা বা পুঁজির উপর থাকবে 'শকুনী মামা'র চোখ। শেষে কোনো উপায়ে ঠেকাতে না পারলে আগুন লাগিয়ে দিয়ে ধ্বংসসাধন বা সর্বনাশ করার কৌশল তো আছেই। এক কথায় অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করে রাখার কৌশল বলা যায়। তবে এতোসব বিপত্তি বাধার মধ্যেও মানুষ তো আশার মুখ না দেখে বেঁচে থাকতে পারে না।
লুঙুদু বাজারে এখনো পাহাড়িরা খুব কমই যায়। বলতে গেলে এখন বাজার মেলেনা। পাহাড়ি জনগণ এখনো বাজারে যেতে ভয় পায়।
লুঙুদুতে পাহাড়ি ও অপাহাড়ির অনুপাত অনেক আগে থেকেই ব্যালেন্সের মধ্যে নেই। সেটলার ও সাধারণ বাঙালি যেখানে ৫০ হাজার, সেখানে পাহড়ির সংখ্যা মাত্র ১৫ অথবা ১৬ হাজার।
পোড়া ঘরের ভিটেমাটিতে ফেরারও যেন কোনো তাড়া নেই পাহাড়ি জনগণের! ঘটনা ঘটেছে জুন মাসের ২ তারিখ। ২৫ জুন পর্যন্ত ধরলে ২৩ দিন হলো পাহাড়িদের পুড়ে যাওয়া ঘর এখনো আগের মতোই যেভাবে পুড়ে ধ্বংস হয়ে ছিলো সেভাবেই আছে।
ক্ষতির শিকার গ্রামবাসীরা এখনো রাত কাটাচ্ছে দূরে প্রত্যন্ত পাহাড়ি গ্রামে আত্মীয় স্বজনের বাড়ি অথবা আশ্রয়কেন্দ্রে। তবে দিন হলেই তারা চলে আসছে তিনটিলা বনবিহারে। সারাদিন তারা সেখানে কাটিয়ে আবার চলে যায় নিরাপদ দূরত্বে।
ক্ষতির শিকার মানুষগুলোর অনেকটা এমন হয়েছে যে, কী আর হবে আবার নতুন করে ঘরবাড়িতে এসে!? নতুন করে ঘরবাড়ি তুলেও আর কী হবে? অনেকটা তিনটিলা গ্রামের কার্বারী অশ্বিনীকুমার চাকমা'র মতো হয়েছে সবার অবস্থা। এই জীবনে যা তিলে তিলে সঞ্চিত ধন, তার আকষ্মিক ধ্বংসসাধনে বিমূঢ় নির্বাক সকলে।
তাদের আগামী যেন থেমে গেছে!
সে যাহোক, আগামীকে রূদ্ধ করার সাধ্য কারোর নেই। তাই স্বাভাবিকের মতো আবার লুঙুদু ঘরপোড়া জনগণ তাদের ভিটেমাটিতে ফিরে আসুক এই আশা আমরা করতে পারি। লুঙুদুবাসী বা পার্বত্যবাসী বরাবরের মতো দাবি জানাতে পারে জীবন ও ভুমি বা বাপদাদার ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদের শিকার যেন হতে না হয়, যেন ক্ষতির শিকার হতে না হয় সেই নিশ্চয়তা পাওয়ার। অথবা সেই গ্যারান্টি যদি নিশ্চিত না হয়, স্বাভাবিকের মতো নিজেদের রক্ষার জন্য প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা যে নিতে হবে তা-ই যে বাস্তব সত্য, এটাই যে বাস্তবতা, তা কেউ বেবুঝ হলেও নিশ্চয়ই বুঝে থাকবে।




No comments:

Post a Comment

সর্বাধিক পঠিত

ইতিহাসের ভ্রান্তি থেকে বিভ্রান্তিকর শিক্ষাঃ পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রসংগ-১৯৪৭ সাল

ইতিহাসের ভ্রান্তি থেকে বিভ্রান্তিকর শিক্ষা তারিখঃ ১৬ আগস্ট, ২০১৭ ইতিহাস একটি জাতি বা জাতিসত্তা তথা জাতিসমষ্টিকে নানাভাবে প্রভাবিত কর...